Dec 10, 2016

জেনে নিন অপটিক্যাল ফাইবারের এ টু জেড।

আসসালামু আলাইকুম। আমি হুমায়ন কবীর আজ আপনাদের জানিয়ে দেব অপটিক্যাল ফাইবার নিয়ে যত কথা। এই সহজ বিষয়টি অনেকের কাছেই অনেক কঠিন বলে মনে হয়। তাই সহজভাবে আপনাদের কাছে বর্ণনা করার চেষ্টা করছি । আশা করি ভাল লাগবেঃ-----
অপটিক্যাল ফাইবারঃ
অপটিক্যাল ফাইবার হল ডাই ইলেকট্রিক পদাথ দিয়ে তৈরী এক ধরনের আঁশ যা আলো নিবন্ধকরণে ও পরিবহণে সক্ষম সরু কাঁচ তন্তু । আলোর র্পূণ অভ্যান্তরীণ প্রতিফলনকে কাজে লাগিয়ে ডাটা স্থানান্তরের জন্য লেজার রশ্মি ব্যবহার করা হয় ।
ইতিহাসঃ
অপটিক্যাল কনসেপ্ট প্রথম আবিস্কার হয় ১৭৯০ সালে ফরাসি বিজ্ঞানী Claude Chappe কর্তৃক আবিস্কৃত অপটিক্যাল টেলিগ্রাফ থেকেই । কিন্তু পরে ইলেক্ট্রিক টেলিগ্রাফ আসায় এই পদ্ধতি অকেজো হয়ে যায়। পরবর্তীতে আলেকজান্ডার গ্রাহাম বেল ১৮৮০ সালে অপটিক্যাল টেলিফোন সিস্টেম আবিস্কার করেন যা ফটোফোন হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছিল। তিনি বাতাসে আলোক সিগণ্যাল পাঠানোর চিন্তা-ভাবনা করেছিলেন কিন্তু আবহাওয়া আলোকে যথার্থভাবে ট্রান্সমিট করতে পারতো না। ফলে তাঁর এই উদ্দেশ্য ব্যাহত হয়। আর বর্তমান ফাইবারে যে আলোর পূর্ণ আভ্যন্তরীন প্রতিফলন হয়, তা আবিস্কার করেন ১৮৪০ সালে সুইস পদার্থবিদ Daniel Collodon ও ফরাসি পদার্থবিদ Jacones Babinet । এই ধারণা নিয়ে ১৯২০ সালে Henrich Lamm এবং Munich টেলিভিশনের ইমেজ বা ছবি স্বচ্ছ কাঁচদণ্ডের মধ্য দিয়ে পাঠাতে সমর্থ হন। কিন্তু তাদের আবিস্কৃত ইমেজ কোয়ালিটি খুব একটা ভাল ছিল না। এতদিন পর্যন্ত যেভাবে ট্রান্সমিশন করা হতো, তার সবই ছিল আনক্লাডিং। সেই কারণে বেশিরভাগ আলো চারদিকে ছড়িয়ে পড়ায় সিগণ্যাল দূর্বল হতো। পরবর্তিতে আমেরিকান পদার্থবিদ Brian O'Brien সর্বপ্রথম ক্লাডিং অপটিক্যাল ফাইবার ব্যবহারে সমর্থ হন।
বাংলাদেশ ও ফাইবার অপটিক কেবল:
বাংলাদেশ মূলত মাইক্রোওয়েভ স্যাটেলাইট এর মাধ্যমে বহিঃবিশ্বের সাথে যুক্ত। বাংলাদেশে মোট দুইটি A স্টার্ন্ডাড এর স্যাটেলাইট সংযোগ আছে।আর তা হল চট্রগ্রামের বেতবুনিয়া ও ঢাকার মহাখালিতে। বঙ্গোপসাগরের তলদেশ দিয়ে তিনটি সাবমেরিন কেবল প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে তা হলো- SMW2, SMW3, FLAG । 1996 সালে অপটিক্যাল ফাইবারের মাধ্যমে অভ্যন্তরিন বড় বড় টেলিফোন সংযুক্ত করার পদক্ষেপ শুরু হয়। ঢাকায় মগবাজারে ও গুলশানের টেলিফোন এ্েঙচঞেজর মধ্যে প্রথম অপটিক্যাল ফাইবার ব্যবহার হয়।
উপাদানঃ 
ফাইবার অপটিক্যাল ক্যাবল তৈরির উপাদানগুলো হল- সোডা, বোরো সিলিকেট, সোডা লাইম সিলিকেট, সোডা এ্যালুমিনা সিলিকেট ইত্যাদি।

যেভাবে অপটিক্যাল ফাইবারের ভিতর দিয়ে আলোর সিগন্যাল যায়:
যখন একটা মাধ্যম থেকে অন্যমাধ্যমে আলো প্রবেশ করে তখন তার দিক একটু পরিবর্তিত হয়, যাকে প্রতিসরাংক বলে৷ যদি প্রথম মাধ্যম থেকে দ্বিতীয় মাধ্যম এর ঘনত্ব কম কিংবা বেশী হয় তবে প্রতিসরিত কোনটি বেকে যাবে৷ কতটুকু বাড়তে তা দুটি মাধ্যমের প্রতিসরাংক ও কত কোণে দ্বিতীয় মাধ্যমে প্রবেশ করছে তার উপর নির্ভর করে৷
Critical Angle  (সংকট কোণ) হল যখন বিশেষ কোণে আর আলোটি বাহির না হয়ে দুটির তল দিয়ে চলা শুরু করবে৷ এইক্ষেত্রে প্রতিসরিত কোণের মান হয় ৯০ ডিগ্রী৷ কিন্তু কোন কারণে যদি Critical Angle (সংকট কোণ) এর থেকে বেশী কোণে আলো প্রবেশ করে তবে আলোটি প্রতিফলিত হয়ে ফিরে আসবে৷ এইভাবে প্রতিফলিত হয়ে ফিরে আসাকে বলে total internal reflection বা র্পূণ অভ্যান্তরীন প্রতিফলন সাধারণ আয়নার ক্ষেত্রে আলো ৯০% থেকে ৯৫% প্রতিফলিত হয়৷ কিন্তু অপটিক্যাল ফাইবার এর ক্ষেত্রে ১০০%ই প্রতিফলিত হয়ে আসে৷ সাধারণ অপটিক্যাল ফাইবারের কোরের প্রতিসরাংক প্রায় ১.৫৫ এবং Cladding এর প্রতিসরাংক প্রায় ১.৪৫৷ ফলে সাধারণ ফাইবার অপটিকের critical (সংকট) কোণ ৬৯ ডিগ্রী,  তাই কোরের ক্ষেত্রে ৬৯ ডিগ্রী এর বেশী কোণে আলো প্রবেশ করে ফলে প্রতিক্ষেত্রে আলো প্রতিফলিত হয়ে আসে৷
অপটিক্যাল ফাইবার এর ভিতরের কোরের ভিতর দিয়ে আলো যাবার সময় তা বার বার আয়নার মত প্রতিফলিত হয়ে চলতে থাকে৷ এইভাবে বারবারই সব জায়গায় প্রতিফলিত হয়ে অপটিক্যাল ফাইবার এর ভিতর দিয়ে আলোর সিগনাল অনেকদূর যায়৷ আর এটাই অপটিক্যাল ফাইবার এর গোপন রহস্য৷ কোরের বাহিরের যে Cladding থাকে তাতে কোন আলো প্রবেশ করে না৷ তাই কেন্দ্রপথটি খুব নিখুঁত ফাইবার দিয়ে তৈরী করা হয়, যেন অনেকদূর যেতে পারে৷ কিন্তু তারপরেও ফাইবার এর সাথে বিভিন্ন অনাকাংখিত উপাদান মিশ্রিত থেকে যায়, তাই অনেক দীর্ঘ অপটিক্যাল ফাইবারের ক্ষেত্রে, পথমধ্যে Optical regenerator ব্যবহৃত হয়৷

অপটিক্যাল ফাইবার
ফাইবার অপটিক রিলে সিসটেম:
অপটিক্যাল ফাইবার দিয়ে সিগনাল পাঠানো ও রিসিভ করার সম্পূর্ণ সিসটেম টিকে ফাইবার অপটিক রিলে সিসটেম বলে৷ এই সিসটেমটি নিম্নলিখিত কাঠামো দিয়ে তৈরী:
ট্রান্সমিটার : এটি কোন তথ্যকে আলোর সিগনাল এ রুপান্তর করে ও আলোর সিগনাল অপটিক্যাল ফাইবার দিয়ে পাঠানোর জন্য তৈরী করে৷ পূর্বেই উল্লেখ করেছি যে লেজার ও LED আলো ব্যবহৃত হয়৷

অপটিক্যাল ফাইবার : এটি মূল আপটিক্যাল ফাইবার, যার ভিতর দিয়ে আলো চলাচল করে৷
অপটিক্যাল জেনারেটর : সাধারণত খুব দীর্ঘ অপটিক্যাল ফাইবারের মধ্যে ব্যবহৃত হয়, আলোর তরঙ্গকে শক্তিশালি করবার জন্য ব্যবহৃত হয়৷ কেন্দ্রপথের ফাইবারে বিভিন্ন অনাকঙ্খিত উপাদান মিশে থাকার কারণে আলো চলবার পথে বাধাপ্রাপ্ত হয়৷ তাই অপটিক্যাল ফাইবার এর দৈর্ঘ প্রায় ১ কিলোমিটার এর বেশী বড় হলে আলোর তরঙ্গগুলিকে শক্তিদিয়ে আলো দূরে পাঠানোর জন্য এই অপটিক্যাল জেনারেটর ব্যবহৃত হয়৷ মূলত এই অপটিক্যাল জেনারেটর এক ধরনের লেজার এম্পিফায়ার এবং এটি ভিতরের প্রবাহমান লেজার আলোকে আরো শক্তি প্রদান করে এবং তা আরো বহুদূর যেতে পারে৷
অপটিক্যাল ফাইবার এর গঠনঃ
অপটিক্যাল ফাইবার খুব সুক্ষ্ম বিশেষ ধরনের গ্লাস ফাইবার দিয়ে তৈরী। আমরা সাধারণত যে কাঁচ দেখি তা হল সিলিকন ডাই অক্সাইড। অণুর বিশেষ বিন্যাসের গঠনগত কারণে কাঁচের ভিতর দিয়ে আলো চলাচল করে, তাই আমরা দেখতে পাই। কিন্তু বিপত্তি হল যদি কাঁচ মোটা হয় তাহলে কাঁচের উপাদানের অনাকাঙ্কিত খাদ থাকায় কাঁচ নীল দেখায়। আর অপটিক্যাল ফাইবার বিশেষ ধরনের কাঁচ যাতে ঐ ধরনের কোন খাদ না থাকায় আলো অতি দ্রুত অনায়াসে অনেক দুর পর্যন্ত যেতে পারে।
অপটিক্যাল ফাইবারে সাধারনত তিনটি অংশ রয়েছে।
1। কোরঃ এটি হল অপটিক্যাল ফাইবারের আলো চলাচলের মূল পথ।
2। ক্লোদিং: এই অংশে কাঁচের প্রতিসারংক কেন্দ্রপথের প্রতিসাংক অপেক্ষা বেশি হয়।
3। বাফার ক্লথিং: এই অংশটি ফাইবারকে তার প্রতিকূল পরিবেশ যেমন: তাপ, চাপ, আঘাত ইত্যাদি থেকে রক্ষা করে। এছাড়াও সব উপরে একটি জ্যাকেট পরানো থাকে যা  সম্পূর্ণ তারটিকে সুরক্ষা দিয়ে থাকে।
প্রকারভেদঃ
অপটিক্যাল ফাইবারকে প্রধানত তিনটি ভাগে ভাগ করা হয়।
  1. STEP INDEX FIBRE : এই ধরনের ফাইবারে কোর এর সকল স্থানে প্রতিসারঙ্ক সমান হয়।
  1. GRADED INDEX FIBRE: এই ধরনের ফাইবারে কোর এর সামনের দিকে প্রতিসারঙ্ক আস্তে আস্তে কমতে থাকে।
  1. MONOMODE: এই ধরনের ফাইবার মূলত এক বর্ণি আলো পরিবহনের কাজে ব্যবহৃত হয়।

এছাড়া অপটিক্যাল ফাইবারের কোরের আকারের উপর ভিত্তি করে দুই ভাগে ভাগ করা হয়।
1। ‍সিঙ্গেল মুড ফাইবার : এটি ছোট আকারের কোর যার ব্যাস 9 মাইক্রন । লেজার আলোর তরঙ্গদৈর্ঘ্য 1300 থেকে 1550 ন্যানোমিটার।
2। মাল্টি মুড ফাইবার: এটি বড় আকারের কোর যার ব্যাস 62 মাইক্রন। এক্ষেত্রে ইনফ্রারেজ ব্যবহার করা হয় যার তরঙ্গ দৈর্ঘ্য 850 থেকে 1300 ন্যানোমিটার।
বৈশিষ্ট্য :
১.বৈদ্যুতিক সংকেতের পরিবর্তে আলোক সংকেত আকারে তথ্য স্থানান্তর করে।
২.ক্যাবলের ভিতর কাঁচের নলটি হালকাভাবে বাঁকা করার ব্যবস্থা আছে, ফলে ভেঙ্গে যায় না।
৩.দ্রুত ডাটা আদান-প্রদান সম্ভব।
৪.বড় ধরনের নেটওয়ার্কে এ ক্যাবল ব্যবহূত হয়।
৫.অতি স্বচ্ছতা।
৬.রাসায়নিক নিস্ক্রিয়তা।
৭.শক্তির অপচয় কম।
৮.সহজ প্রক্রিয়াকরণ যোগ্যতা।

সুবিধা: :
১. উচ্চ গতি, চ্যানেল সংখ্যা বেশি, আকারে ছোট, নমনীয় এবং ওজন অত্যন্ত কম।
২.আলোর তীব্রতা ও গতি বেশি বলে একে সহজে দূরের জায়গায় পাঠানো যায়।
৩. বেশি দূরত্বেও শক্তি অক্ষুণ্ন থাকে এবং শক্তি ক্ষয় কম হয়।

৪. অন্তরক পদার্থ দিয়ে তৈরি বলে বিদ্যুত্ চৌম্বকীয় প্রভাব থেকে মুক্ত।
৫. ডাটা সংরক্ষণের নিরাপত্তা ও গোপনীয়তা সবচেয়ে বেশি।

অসুবিধাঃ
১.ফাইবার অপটিক্যাল অত্যন্ত দামী।
২.ফাইবার অপটিক্যাল ক্যাবল ইনস্টল করা অন্যান্য ক্যাবলের চেয়ে তুলনামূলকভাবে ঝামেলাপূর্ণ।

ধন্যবা

1 comment: